উত্তর :
মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত আলোচ্য নীলধ্বজের প্রতি জনা শীর্ষক পত্রকাব্যের এক প্রধান চরিত্র হলো রানী জনা। তাই জনা চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে নবজাগরণের যুগের এক প্রতিবাদী নারীকে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যের মধ্য দিয়ে আলচ্য।
জনার চরিত্রটির মধ্যে এক দিকে আমরা যেমন দেখতে পাই তার মাতৃসত্ত্বা অন্যদিকে তেমনি দেখা যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা। জনার চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য গুলি উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি নিচে আলোচিত হলো --
অর্জুনের হাতে নিজের পুত্রের হত্যাতে জনা পুত্র শোকের আকুলতাকে অন্তরে চেপে রেখে চোখের জল রূপান্তরিত করেছেন ক্রোধের আগুনে। পুত্র বিহান তার অন্তরে যে যন্ত্রণার উদ্ভব হয়েছে তাকে তিনি কোন মতে নিবারণ করতে পারেননি তাই তিনি বলেছেন -
"ভুলিব এ জ্বালা,
এ বিষম জ্বালা, দেব, ভুলিব সত্বরে!"
জনা একদিকে যেমন ছিলেন ক্ষত্রিয় কুলো বধূ তেমনই অপরদিকে তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় কূল বালা। তাই তিনি তার স্বামীর অন্তরে ক্ষত্রিয় ধর্মকে জাগ্রত করে তুলেছিল। জনা চেয়েছিলেন তার স্বামী যেন ক্ষত্রিয় ধর্ম উদ্বুদ্ধ হয়ে পুত্র হত্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করে, তাই জনার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল -
"ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম এই কি, নৃমণি?
কোথা ধনু, কোথা তুণ, কোথা চর্ম্ম, অসি?"
জনা চরিত্রটির মধ্যে যেমন প্রতিবাদী সত্তা রয়েছে তেমনি রয়েছে তার প্রেমিক সত্তাও। আলোচ্য পত্রকাব্যে তা কিছু অস্পষ্ট নয়। তার আহত প্রেমিক তাকে অভিমানি করে তুলেছে। তাই তিনি অভিমানের সুরে বলেছেন
"তুমি পতি, ভাগ্যদোষে বাম মম প্রতি"
জনা চরিত্রে তার একটি বিশেষ গুণ হলো শাস্ত্র, বেদ, পুরান, ইতিহাস সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান। তাই স্বামীকে ভৎসনার সময় অর্জুনের বংশ গরিমার অসরতা প্রমাণ করার জন্য মহাভারত রচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ ব্যাসের চারিত্রিক হীন মান্যতা প্রমাণ করার জন্য পাণ্ডব কৌরব বংশের ইতিহাস কে এবং সত্যবতী পুত্র ব্যাসদেবের নির্লজ্জতা কে অনায়াসে বিবৃত করেছেন, তাই তিনি উল্লেখ করেছেন --
"দ্বৈপায়ন ঋষি
পাণ্ডব-কীর্ত্তন গান গায়েন সতত।"
জনা চরিত্রে আরেকটি বিশেষ গুণ হলো তার মাতৃসত্ত্বা। পুত্রের হত্যাকারীর সঙ্গে স্বামী নিলধ্বজ সখা স্থাপন করেছিলেন। তখন প্রতিবাদিহীন স্বামীর অপরাধে যখন বিচারের বাণী নিরব, নিভৃতে কাঁদে ঠিক তখনই। অসহায় জনা আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে নিজেকে শেষ করতে চেয়ে বলেছেন
" ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে "
জনার চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদী সত্তার মতো মাতৃ সত্তা ও প্রবল ভাবে ধারা পড়েছে। তাই মাতৃ সত্তা ও জনা চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। প্রতিবাদী ও বীর ধর্মের অন্যায় মিশলে জনার মাতৃ সত্তার এই পত্রকাব্য এক মহাকাব্যক রূপ পেয়েছে।
সবশেষে বলতে পারি অর্জুনের ভ্রস্টাচার ও অসত্ততার অমানবিকতার প্রতি জনা যথার্থভাবে কটাক্ষ করেছেন। সন্তানহারা জননীর প্রসাবতি যে প্রয়াস এই পত্রকাব্যের জনার মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে তাতে বোঝা যায় চরিত্রটি সর্বাঙ্গে বীরাঙ্গনা ও নারীর পূর্ণ বিকাশ সমজ্জ্বল ।।