কর্তার ভূত গল্পের বিষয়বস্তু ও রূপক বিশ্লেষণ করো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের প্রথম প্রতিশ্রুতি ও পরিণত পথরেখাও। তার লিপিকার অন্তর্গত কর্তার ভূত গল্পটি কোন ভয়াকীর্ণ ভৌতিক সৃষ্টিকারী মামুলি ভূতের গল্প নয়। গল্পটি রূপক গল্প। এক ভৌতিক গল্পের রুপাধাই গল্পকার আচারাচ্ছন্ন, প্রথাজীর্ণ, মৃত কল্প দেশবাসীর মনে ভীতি দূর করে জীবনকে এক সত্য ভিতিতে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।
বুড়ো কর্তা মারা যাওয়ার পর ভূত হয়ে দেশসুদ্ধ লোকের গায়ে চেপে বসে। দেশসুদ্ধ মানুষ ভূতগ্রস্ত হয়ে চোখ বুজে অদৃষ্টের চালে চলতে থাকে এবং কর্মহীন নিশ্চেষ্ট জীবনযাপন করতে থাকে। কিন্তু মুশকিল হল পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোকে ভুতে পায়নি সে কারণেই তারা ভয়ঙ্কর সজাগ এবং ভবিষ্যতের রথচক্রটাকে সজাগ রাখতে সক্ষম। এ সময় দেশের বর্গীদের আগমন ঘটে এবং ধান খেয়ে যায় নানা জাতের বুলবুলি কিন্তু খাজনার দাবি ওঠে এদিক থেকে ওদিক থেকে দেশের মানুষকে তখন আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে পূরণ করতে হয়। আর তখনই প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু শিরোমনিদের শাস্ত্রের বচনে তারা চুপ করে যায়, অর্বাচিন্দে ভূত ছাড়ানোর ওস্তাদও ভুতের নায়েবের রক্তচক্ষুর ভয়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তবুও দু-একজন অবধের প্রশ্ন শোনা যায় তখনো যে কর্তা ছাড়বার সময় হয়েছে কিনা। তখনই বুড়ো কর্তা জানায় 'আমার ধরাও নেই ছাড়াও নেই তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া'।
প্রশ্নকারীরা তখন ভীরুতা দেখালে কর্তা বলেন সেখানেই তো ভূত।
গল্পটির রূপক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে কর্তার ভূত প্রকৃতপক্ষে সনাতন ধর্মীয় বিধান, জীর্ণ পুরাতন লোকাচার বা শাস্ত্রাচার বা প্রাচীন সংস্কার। এগুলির সত্যাসত্য যাচাই না করেই এগুলোর প্রতি আমরা প্রশ্নহীন আনুগত্য দেখাই ও নম্র আত্মসমর্পণ করি। সত্যকে সংগুপ্ত করেই এই সকল প্রথা বা সংস্কার জীবনকে পঙ্গু করে দেয় জীবনকে অচল, অসার, গতি স্তব্ধ করে তোলে। মানুষের মনের ভয় অন্ধবিশ্বাস এবং দৃষ্টির আচ্ছন্নতার ফলে ভুতের এই কর্তৃত্ব। কিন্তু অন্যান্য দেশের মানুষ কুসঙস্কারাচ্ছন্ন নয় তারা সত্যের দিশারী, যুক্তিবাদী মানসিকতার অধিকারী। সেজন্য তাদের জীবন অনেক বেশি কর্মমুখর, তাদের জীবন অনেক বেশি প্রগতিশীল, উন্নত।