ডাকাতের মা গল্প অবলম্বনে ডাকাতের মায়ের মাতৃস্বরূপটি উদঘাটন করো।
স্বাধীনতার পূর্বে গল্প লেখকদের মধ্যে এক স্পৃহণীয় নাম সতীনাথ ভাদুড়ী। মনোগহনের পথে স্বচ্ছন্দ বিচরণ এবং চরিত্র উদঘাটনে অনায়াস দক্ষতা ছিল তার। তার ডাকাতের মা গল্পটি সেই হিসেবে এক মায়ের হৃদয়ের সুপ্ত তলে গুপ্ত মাতৃত্বের আবিষ্কার। সে মাতৃত্ব সমস্ত পাপ পুণ্যের ঊর্ধ্বে সংসারের মানদণ্ডে নির্ধারিত পাপ-পুণ্যের সে ধার ধারে না - "A mother, a mother born in vain".
নামকরণের সূত্রেই বলা যায় ডাকাতের মা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু ডাকাতের বউ ই হোক আর মা ই হোক তার মধ্যে কোন নির্দয় নিষ্ঠুর, ভয় শূণ্য, ভীতি ও ঘৃনা উদ্বেগকারী নারীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এক কমনীয় বাৎসল্য ভরা এক মমতাময়ী মা কে খুঁজে পাওয়া যায়। ডাকাতের মা যেন এক মাতৃসত্তার বাক-প্রতিমা।
রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পে যেমন এক দেশকাল নিরপেক্ষ চিরন্তন পিতাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তেমনি ডাকাতের মা গল্পে ডাকাতের মায়ের মধ্যে তেমনি এক চিরন্তন মাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সীমা কালকে অতিক্রম করে এই মাতৃস্নেহ চিরন্তন ও শাশ্বত। সমস্ত ব্যবধান পেরিয়ে এই অপত্য স্নেহ অবগাহন করে পৃথিবীর সব মা। পৃথিবীর সব কালে সব দেশেই সব মাতার হৃদয় থেকেই একই স্নেহধারা উৎসারিত হয়। তা কোন সাধু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত বংশীয় মাই হোক আর ডাকাতের মাই হোক সবাই সমান।
গল্পের আদ্যন্তই তার মাতৃত্বের পরিচয় বিধৃত। তার বাড়িতে দরজা খোলার জন্য যে সংকেত পূর্ণ নির্দেশগুলো ছিল তা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। ছেলের কথামতো সে পাঁচ বছরের মধ্যে একবারের জন্য শীতের সময় কম্বলমুড়ি দেয়নি। এমন ঘটনা গুলির মধ্যে পুত্রের কর্তৃত্ব যতটা ততটাই মাতৃত্বের বিশ্বাস। ডাকাতের মা বলে নিজের প্রতি কোন সংকুচিত স্বীকৃতি ছিল না বরং চৌকিদার সাহেব তার ছেলের নামে কাপে। দারোগা সাহেব তুই তারাকি করতে সাহস পায় না। ছেলের এমন আভিজাত্যে তার অহংকার ছিল, এত অন্ধ মাতৃত্বেরই অমলিন ভাবাবেগ।
সৌখির মায়ের মাতৃত্বের পূর্ণ স্বরূপ স্পষ্ট হয় সৌখির জেল থেকে ফিরে আসার পর। সৌখির শরীরের ভগ্নদশায় তার মায়ের উদ্বেগ এক স্নেহ কাতরা মমতাময়ী মাকে চিনিয়ে দেয়। ছেলেকে কাছে রাখতে সে দলের লোকের বিশ্বাসঘাতকতা ও বউ নাতির বাড়িতে না থাকার প্রকৃত কারণ সে গোপন করেছে। পরবর্তী ঘটনা এক আত্মক্ষয়কারী সন্তান স্নেহপ্রীতির পারবস্য ও অন্ধ মাতৃত্বকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সৌখির প্রিয় আলু চচ্চড়ির সঙ্গতি তার ছিল না, অগত্যা পেশকারের সে লোটা চুরি করে। চুরি করা পাপ কিন্তু এই চুরির অন্তরালেই তো উজ্জ্বলিত দুর্বার মাতৃত্ব। তার এই অমলিন মাতৃত্বের নির্ঝরে মুছে যায় তার চুরির কলঙ্ক। তখন ডাকাতের মাকে কি মনে হয় না।