বাংলা সাহিত্যে তুর্কি আক্রমণের প্রভাব আলোচনা করো ।
সমস্ত সমাজেই পরিবর্তনের একটি মূল কারণ হলো বহিরাগত শক্তি ও ধ্যান-ধারণার অভিঘাত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়ের কারণেই বাঙ্গালীদের জীবনে এক রেনেসাঁস বা নবজাগরণের অভ্যুদয় ঘটে ছিল। অনুরূপে তুর্কি আক্রমণের ফলে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, সমাজ দেহেও গভীর রূপান্তরের সূত্রপাত হয়।
১. নৃতাত্ত্বিক :-
বাঙালি জাতি বলতে যা বোঝায় তাতে আর্য অনার্য দুধরনের উপাদানই ছিল। এই দুই স্তরের মধ্যে হৃদয় ও ব্যবহারিক বিচ্ছিন্ন টাই ছিল বড়। তুর্কি আক্রমণের প্রচন্ড আঘাতে খানিকটা আত্ম রক্ষার তাগিদে পরস্পর বিচ্ছিন্ন আর্য ও অনার্য হিন্দু জনগণ কিছুটা পরস্পরের নিকটবর্তী হলো।
২. সমাজ সংস্কার গত :
হিন্দু সমাজের পুনর্বিন্যাস ঘটল, সেইসঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক নতুন উপাদান অনুপ্রবিষ্ট হলো - মুসলমান সম্প্রদায়। অগণিত মানুষ ইসলামের আশ্রয় গ্রহণ করল। একদিকে হিন্দুসমাজ অন্যদিকে নবাগত শাসক গোষ্ঠী ও ধর্মান্তরিত নব্য মুসলিম দল ক্রমে বাঙালি এই বৃহৎ পরিচয় লীন হল।
৩. অর্থনীতি গত :
তুর্কি আক্রমণের আগে বাঙালির প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকর্ম ও বহির্বাণিজ্য। তুর্কি বিজয়ের পর থেকে বাঙালি গৃহ কেন্দ্রিক হলো। দেশের মধ্যবর্তী সপ্তগ্রাম, গৌর, হুগলি, চট্টগ্রাম প্রভৃতি বড় বড় কোনো পণ্য চলাচলের কেন্দ্র ও নগর গড়ে উঠল।
৪. ধর্মবিশ্বাস গত :
চৈতন্য প্রবর্তিত প্রেম ধর্ম ও সুখিবাদের মধ্যে সম্ভাব্য যোগ, মুসলিম কবিদের বৈষ্ণব পদ রচনা ইত্যাদি ছাড়াও দুই ধর্মের সংযোগ ঘটল সত্যপীর, কাজিপীর, ওলাইচন্ডী, বনদেবী ইত্যাদি নতুন দেবতার মধ্যে। এরা দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দ্বারাই পূজিত হতে থাকলো।
৫. সাহিত্য-সংস্কৃতি গত :
তুর্কি আক্রমণের ফলে আপাতভাবে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিলেও বরং আমরা লক্ষ্য করি হোসেন শাহ প্রভৃতি সহৃদয় পৃষ্ঠপোষকতায় এরপরই বাংলা ভাষার নিজস্ব সাহিত্য গড়ে উঠলো। তুর্কি আক্রমণের ফলে পাল যুগের সমৃদ্ধ তখন শিল্প ও প্রতিমা নির্মাণ কলার অবলুপ্তি ঘটে বলা চলে। পক্ষান্তরে মসজিদ-মন্দির ইত্যাদিতে স্থাপত্যরীতি, নকশার কাজ ইত্যাদি করে উঠলো।
এককথায় তুর্কি আক্রমণের ফল বাংলার ক্ষেত্রে যেমন সর্বব্যাপী তেমনি সুদূরপ্রসারী।