নীল বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব সম্পর্কে লেখ।

নীল বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব সম্পর্কে লেখ।


ভূমিকা:

 নীল একপ্রকার রঞ্জক পদার্থ। ইংল্যান্ডের শিল্প-কলকারখানায় উৎপন্ন বস্ত্রসামগ্রী রঞ্জিত করার জন্য ইংরেজি নীলকর সাহেবরা ভারতে নীল সংগ্রহ করত। ভারতবর্ষ ছিল নীল উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। এই উৎপাদন কে কেন্দ্র করে নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকরা নীল বিদ্রোহ শুরু করেছিল।

সময়কাল: 
নীল বিদ্রোহের সময়কাল ছিল ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দ।

নীল বিদ্রোহের কারণ:

দাদন প্রথা: 
দাদন প্রথা নীল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। যেসব চাষী দাদন বা অগ্রিম দিত তারা বংশ পরম্পরায় নীল চাষ করতে বাধ্য হত। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে এই প্রথার অত্যাচারের বিষয়টি উল্লেখিত রয়েছে।

জমি মাপে কারচুকি: 

নীলকর সাহেবরা অতিরিক্ত নীলের আশায় কম জমিতে বেশি পরিমাণ নীল চাষ করিয়ে নিত।

নীলকরদের অত্যাচার: 
নীল চাষ না করলে নীলকর সাহেবরা চাষীদের জোর করে নীলকুঠিতে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার চালাত।

গৃহস্থের পশু হরণ: 
নির্যাতিতের নীল চাষে বাধ্য করার জন্য নীলকররা গৃহস্থের গরু-বাছুর লুট করে নিয়ে গিয়ে নীলকুঠিতে বেঁধে রাখতো। এমনকি অসম চাষীদের গৃহে আগুন লাগিয়ে দিত। শিশির কুমারের ‘ অমৃতবাজার পত্রিকা' ও দীনবন্ধু মিত্রের ‘ নীলদর্পণ' নাটকে এরূপ মর্মান্তিক দৃশ্যের বিবরণ রয়েছে।

ধান চাষের পরিবর্তে নীল চাষ:
 নীলকররা অধিক নীলের আশায় উর্বর জমির ধান চাষের পরিবর্তে নীল চাষ করাতে বাধ্য করতো। খাদ্যশস্যের অভাব কৃষকদের মধ্যে নীলকরদের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ ঘনীভূত হয়।

বিদ্রোহ: 
নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিকারের লক্ষ্যে নদীয়ার চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরন বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। এছাড়াও এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দানে এগিয়ে আসেন বিশ্বনাথ সর্দার ,বৈদ্যনাথ সর্দার , রাম রতন মল্লিক , কাদের মোল্লা , রফিক মন্ডল প্রমুখ। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে পাবনা , ফরিদপুর, মুর্শিদাবাদ , রাজশাহী, মালদহ প্রভৃতি স্থানে।

নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব:

(১) ঐক্যের প্রতিষ্ঠা: এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ভারতে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক জমিদার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, এবং হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের প্রতিষ্ঠিত হয়।

(২) নীল চুক্তি আইন: এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে নীল কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে অষ্টম আইন দ্বারা নীল চুক্তি আইন বাতিল করা হয় এবং একাদশ আইন দ্বারা নিজের ইচ্ছাধীন স্বীকৃত হয়।

(৩) প্রথম ধর্মঘটের নজর: ঐতিহাসিক এল নটরাজন বলেছিলেন নীল চাষ করতে অস্বীকার করে কৃষকরা যে ধর্মঘট হয়েছিল তা ধর্মঘটের প্রথম নজির হিসাবে স্বীকৃত।

(৪) স্বাধীনতার প্রভাব: অমৃতবাজার পত্রিকার মতে এই বিদ্রোহ অর্ধমৃত বাঙালির স্বাধীনতার উষ্ণ রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল।

(৫) রাজনৈতিক সহযোগিতা: অধ্যাপক শিশির কুমার ঘোষ এর মতে এই বিদ্রোহ ভারতবাসীকে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল এবং বাংলার প্রথম বিপ্লবী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

            সুতরাং হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর মতে এর সঙ্গে মন মিলিয়ে বলতে পারি যে শক্তি, অর্থ ও রাজনৈতিক জ্ঞান না থাকলেও বাংলার কৃষককুল যেভাবে বিদ্রোহ সংঘটিত করেছে তার গুরুত্ব অপরিসীম।

আরো অন্যান্য প্রশ্নগুলি দেখুন :

Post a Comment

এই তথ্যের ব্যাপারে আরো কিছু জানা থাকলে বা অন্য কোনো প্রশ্ন থাকলে এখানে লিখতে পারেন ।